চট্টগ্রাম রিপোর্টার
করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামে কোনো আইসিইউ খালি নেই। নেই কোনো সাধারণ বেডও। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছে মানুষ।
শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও একটু আশ্রয় পাচ্ছে না চট্টগ্রামের অসংখ্য মানুষ। করোনা চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর জন্য আকুতি জানানো হয়েছে। সরকারি সহায়তায় ডাক্তার এবং নার্স পেলে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরো অন্তত তিনশ’ বেডের করোনা হাসপাতাল চালু করতে পারবে বলে জানিয়েছে।
চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার বেহাল অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে করোনা আক্রান্ত বুড়ো মায়ের জন্য একটি আইসিইউ বেড যোগাড় হওয়ায় হাফ ছাড়লো পরিবার।
আইসিইউতে মাকে ঢুকিয়ে দিয়ে পরিবারের সদস্যরা যখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তখন শরীরে উপসর্গ দেখা গেল পরিবারের অপর এক সদস্যের, ওই মায়ের সন্তানের। দুইদিনের মাথায় যুবকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলো। দ্রুত তাকে নেয়া হলো হাসপাতালে। তার বর্ণনা দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্রুত কমছিল। বাড়াতে হচ্ছিল অক্সিজেন প্রবাহ। সাধারণ বেডে ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন দেয়া সম্ভব হয় না। নিতে হবে আইসিইউতে। কিন্তু ওই হাসপাতাল তো দূরের কথা, শহরের কোনো হাসপাতালেই আইসিইউ বেড খালি নেই। সবখানেই করোনা রোগী। এদিকে অক্সিজেন ফ্লো বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় যুবকের শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। ক্রমে কষ্ট বাড়তে থাকে। পানি ভর্তি বালতিতে নাকমুখ ডুবিয়ে ধরা কিংবা বালিশ চাপা দেওয়ার মতো কষ্ট। মা চিকিৎসা নিচ্ছেন আইসিইউতে, জেনারেল বেডে চিকিৎসাধীন সন্তান ভুগছে শ্বাসকষ্টে। কথাটি মায়ের কানে যেতেই তিনি নিজ হাতে মুখ থেকে খুলে ফেলেন অক্সিজেন মাস্ক। নিজেকে সাধারণ বেডে দিয়ে সন্তানকে আইসিইউ বেডে এনে তাকে বাঁচাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ডাক্তাররা আপত্তি করেন। বৃদ্ধা মায়ের অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু সন্তান শিমুল পালের (৩৮) কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না মা। তিনি কোনো চিকিৎসাই নেবেন না বলে জেদ ধরেন। এক পর্যায়ে মায়ের জেদের কাছে হার মানেন চিকিৎসকেরা। মায়ের ভালোবাসার কাছে অসহায় হয়ে ওঠে চিকিৎসাবিজ্ঞান। মা কানন প্রভা পালকে (৬৫) জেনারেল বেডে স্থানান্তর করে সন্তান শিমুল পালকে (৩৮) দেয়া হয় আইসিইউ বেডে। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কানন প্রভা। শিমুল পাল হাসপাতালে করোনার সাথে যুদ্ধ করছেন।
এটি কোনো গল্প নয়, সিনেমার কাহিনীও নয়। গত বুধবার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ঘটে। সন্তানকে বাঁচার পথ করে দিতে জীবন উজাড় করে দিলেন মা। নগরীর দিদার মার্কেট এলাকার কানন প্রভা পাল এবং সন্তান শিমুল পালের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা ভয়াল করোনায় চট্টগ্রামের চিকিৎসাখাতের চরম অসহায়ত্বের চিত্রই ফুটিয়ে তুলেছে বলে সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
প্রসঙ্গক্রমে অপর একটি ঘটনার উল্লেখ করে সূত্র জানায়, ঠিক এক বছর আগে এমন ঘটনা ঘটেছিল এই জেনারেল হাসপাতালেই। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের পরিচালক দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইয়ের ভেন্টিলেটর খুলে লাগাতে হয়েছিল ছোট ভাইয়ের মুখে। ওই ঘটনায় বড় ভাই মারা গিয়েছিলেন। অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেটরের অভাবে তীব্র শ্বাসকষ্ট সয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। ওই ঘটনার এক বছব পর যেন ঠিক একই রকমের ঘটনা ঘটলো কানন প্রভা এবং শিমুল পালের জীবনে। গত এক বছরেরও বেশি সময়ে করোনার নানা ভেরিয়েন্টের উন্নতি হয়েছে, বিস্তার ঘটেছে আরো ব্যাপকভাবে। কিন্তু চট্টগ্রামের চিকিৎসা খাতের অসহায়ত্ব কমেনি, কমেনি ভয়াবহতা। মা মৃত্যুর কোলে শুয়ে বাঁচার জায়গা করে দিতে হচ্ছে সন্তানকে।
বোয়ালখালীতে ঘটলো হৃদয়বিদারক আরো একটি ঘটনা। রাতে করোনায় বাবা মারা গেলেন। পিতার কবর খোঁড়ার সময় জানা গেল মারা গেছে পুত্রও। দুইটি কবরে পিতাপুত্রকে শুইয়ে দেওয়ার এই ঘটনায় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
চট্টগ্রামে করোনার বিস্তার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। কেউ হাসপাতালে এসে মারা যাচ্ছে, কেউবা হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতেও পারছে না। কেউ করোনা পরীক্ষা করছে, কেউ পরীক্ষাও করাতে পারছে না। জ্বরে ভুগে শ্বাসকষ্ট সয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ কোনো পরীক্ষাও করাচ্ছে না, চিকিৎসাও নিতে পারছে না। অনেকে চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে শহরে এসে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছে না। শ্বাসকষ্টে ভোগা বহু মানুষই আইসিইউর দেখা পাচ্ছে না। বহু রোগী পাচ্ছে না একটি সাধারণ বেডও। আইসিইউ তো দূরের কথা, শহরের কোনো হাসপাতালে কোনো বেডই খালি নেই। গতকাল শহরে অসংখ্য রোগী হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ১৭৩ জন রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। এর বাইরে গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ৩৫ জন রোগীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যাদের মধ্যে ৫ জন ছিল মুমূর্ষু। ওই পাঁচজন যখন তখন মারা যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছালেও সিটের অভাবে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ট্রেজারার রেজাউল করিম আজাদ। চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে তিনি জানিয়েছেন, সকাল থেকে একের পর এক রোগীকে ফেরত দিতে হয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের কোনো হাসপাতালে কোনো সিট খালি না থাকা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, রোগীর সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে সিট বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালেরই একই অবস্থা। চমেক হাসপাতালে নির্ধারিত বেডের বহু বেশি সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দুইটি বেডের মাঝখানে ফ্লোরেও রাখা হয়েছে রোগী। নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে রোগী নেওয়ার কোনো জায়গা নেই। আইসিইউগুলো ঠাসা। কোনো কোনো হাসপাতালে একদিনের আইসিইউর বিল নেওয়া হচ্ছে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার টাকা। টাকা দিয়েও করোনার চিকিৎসা পাচ্ছে না মানুষ। বেড না থাকায় চট্টগ্রামের চিকিৎসা সংকট ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ।
বিদ্যমান সংকটের মাঝে করোনা চিকিৎসায় অনন্য হয়ে ওঠা চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল নতুন একটি ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, করোনা ইউনিটে আইসিইউ, এইচডিইউসহ ১৭০ বেডে চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। গতকাল এই হাসপাতালে রোগী ছিল ১৭৩ জন। আর একজন রোগীও নেওয়ার সুযোগ নেই হাসপাতালটির। কেউ মারা গেলে বা সুস্থ হলেই কেবল বেড খালি হবে, অন্যথায় ভর্তি বন্ধ।
ভয়াবহ এই অবস্থায় মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারের প্রতি একটি আহ্বান জানিয়ে হাসপাতালের ট্রেজারার রেজাউল করিম আজাদ বলেছেন, তারা এক লাখ বর্গফুটের ভবন করোনা চিকিৎসার জন্য দিতে পারবেন। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত ডাক্তার এবং নার্স নেই। বর্তমানে তারা ৪ জন কনসালটেন্ট, ৩৫ জন মেডিকেল অফিসার এবং ৫৫ জন নার্স দিয়ে করোনা ইউনিট পরিচালনা করছেন। যদি তাদেরকে ডাক্তার এবং নার্স দেওয়া হয় তাহলে তারা আরো অন্তত তিনশ’ বেডের করোনা ইউনিট পরিচালনা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাদেরকে বৈদ্যুতিক সার্পোট দিতে হবে। বর্তমানে তাদের যে সাবস্টেশন এবং জেনারেটর রয়েছে তা দিয়ে হাসপাতালের লোড ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। রেজাউল করিম আজাদ জানান, শুধু ডাক্তার নার্সের সংকটেই তাদের পক্ষে আর রোগী ভর্তি করানো সম্ভব হচ্ছে না। না হয় তাদের জায়গার অভাব নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে বিরাজিত সংকটের মাঝে মা ও শিশু হাসপাতালের এই প্রস্তাব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করছে। তারা বলছেন, এই হাসপাতালে চল্লিশ জনের মতো ডাক্তার এবং পঞ্চাশ জন নার্স যোগান দেওয়া গেলে করোনা চিকিৎসায় অন্তত আরো দুইশ’ বেড সম্প্রসারিত হতো। যা চট্টগ্রামের কষ্টে থাকা মানুষগুলোর অবলম্বন হয়ে উঠতো বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মা ও শিশু হাসপাতালের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতাল, চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল কিংবা নতুন কোনো হাসপাতাল বা ভবনে রোগী ভর্তি এবং চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করা হলে চট্টগ্রামের মানুষ রক্ষা পেতো। একটি সাধারণ বিছানা করে অক্সিজেন সিলিন্ডার বা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংস্থান করা গেলে শ্বাস কষ্ট থেকে মানুষ রক্ষা পাবে বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
Leave a Reply